লহরী - বাংলা উপন্যাস ( পর্ব - ৩ ) - Ever Fact

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Monday, September 7, 2020

লহরী - বাংলা উপন্যাস ( পর্ব - ৩ )


ঘরের প্রধান খুটি ছাড়া যেমন ঘর মূল্যহীন, ঠিক তেমনি অবস্থা হলো আমাদের পরিবারের। ধীরে ধীরে পরিবার ভাঙতে শুরু করে। সবাই পারিবারিকভাবে আলাদা হয়ে যায় এবং সম্পত্তি ভাগাভাগি করা হয়। এমনকি দাদিকেও ভাগাভাগি করা হয়। দাদি ছয় মাস করে তার একজন ছেলের কাছে থাকবেন। আমার বাবা একা দাদিকে রাখতে চাইলে সেটা মেনে নেওয়া হয় না। আমার একমাত্র ফুফু এই ভাগাভাগির বিষয়ে আপত্তি করলে উনার সাথে সবার সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। প্রচুর অবহেলায় পড়ে যাই আমি। আমি তো আগের মতই দুষ্টামি করতাম কিন্তু তার ফলাফল অন্যরকম হতো। আমার চাচিরা তো সরাসরি বলে উঠতেন, দাদু এখন নেই, আমার জোরও নেইযেকোনো বিষয়ে আমি কিছু করলে সেটা বড় করে তৈরি করে নালিশ করা হতো। আমার আম্মু আমাকে মাথা নিচু করে বাঁচতে শিখাতেন। তবে আমি বুঝতে পারতাম মাথা নিচু করে বাঁচার চেয়ে মরাই ভাল। সবার মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারনা তৈরি করা হয়। আমি একা একা বসে থাকতাম। তখন অর্পাও অনেক ছোট ছিল। আমি আর কারর সাথে মিশতাম না। ভাল না লাগলে টিভি দেখতাম আর ঘরের মধ্যেই অর্পাকে নিয়ে খেলতাম। আম্মি তখন ৮ বছরের ছিলাম। তখনই আমি বুঝতে পারতাম দাদু বেঁচে থাকতে তারা আমাকে মিথ্যা আদরের নাটক করতো। এখন আর কেউ আমাকে শাহরিয়াজ বলেও ডাকে না। সবাই অপু বলেই ডাকেভাবলাম দাদু মারা যাবার পর দাদুর রাখা নামও তার সাথে সাথে বিলিন হয়ে গেছে।

ভীষণ অবহেলায় পড়ে গেলাম আমি। নিজেকে বদলানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমাকে দিয়ে এটা সম্ভব হচ্ছিল না। আমাকে প্রতি ক্ষনে ক্ষনে অপমানিত হতে হয়। আমাকে সান্তনা দেওয়ার জন্যও কেউ নেই। আমার আম্মুও প্রতি ক্ষনে আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন সবার সাথে মিলে চলার জন্য এবং প্রয়োজন হলে নিজের মাথা নিচু করে। আমিও চাইছিলাম সবার সাথে মিলে মিশে চলতে তবে তারা কেউ আমাকে কোনো গুরুত্ব দেয় না। কোথাও বেড়াতে গেলে আমাকে ছোট বলে অবহেলা করে করে তাদের সাথে নেওয়া হত না, কোনো ধরনের খেলায় আমাকে নেওয়া হত না। সবার কাছে আমার নামে নানা খারাপ চিন্তা ভাবনা তৈরি হয়। বিশেষ করে আমার চাচিরা এবং চাচাতো ভাই বোনরা, যারা আগে আমাকে হিংসা করতো। চাচারা হয়তো আমাকে মন থেকে ভালবাসতেন তবে তারা তাদের স্ত্রীদের ভয়ে তা প্রকাশ করতেন না। তবে আমি কখনও তাদের সাথে কোনো অভদ্রতা করিনি। অবশেষে আমার অবস্থা এমন হয় যে আমি আর ঘরের বাইরেই বের হই না। দাদি আমার জন্য কাদের তাই দাদিকে তারা অনেক অপমান করতো। এজন্যই আমি দাদির কাছে যাই না। তখন পারিবারিক ভাবে কোনো ঝগড়া ছিল না। সবাই একসাথে চলতো, শুধু আমিই আলাদা। আমি প্রায় সেচ্ছায় ঘরে বন্দি হই। কারণ আমি এমন অপমান সহ্য করতে পারি না। আমার বাবা কিছুদিন পর দেশে ফিরেন। সবার জন্যই অনেক কিছু আনেন তবে আমার আর আমার বোনের জন্য আলাদা কিছু নিয়ে আসেন।

সেগুলো আর আমার রইত না, আমার কাছে থেকে হাতছাড়া হয়ে যেত। একে একে আমার সব অধিকার আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। আমার বাবা ছিলেন খুব সহজ সরল মানুষ তবে আমাকে তিনি অনেক ভালবাসতেন এবং আমাকে মন থেকে বিশ্বাস করতেন। আমার চাচাতো ভাই বোনরা আমার নামে মিথ্যা মিথ্যা নালিশ করতো আমার নামে। আম্মু আমার সব সহ্য করে নিতে বলেন তবে আমার বাবা আমাকে সাহজ যোগান। তিনি বলেন যদি পৃথিবীতে পূর্নরুপে বাঁচতে হয় তাহলে মাথা উচু করে বাচবে। কখনও নিজের মাথা নিচু করবে না, প্রয়োজন হলে আমাদের সামনেও না। তখনই আমি বুঝতে পারলাম আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য একজন তো আছে। বাকী ছিলেন আমার ফুফু, যাকে অনেক দিন হলো আমি দেখি না। কখনও কোনো সুত্রে জনতে পারি ফুফু আমাকে দেখার জন্য অকুল হয়ে আছেন। তবে এত ছোট বয়সে ফুফুর সাথে আমার একা দেখা করা সম্ভব ছিল না।

আমার বাবা যখন দেশে ছিলেন তখন আমার দাদি আমাদের কাছেই ছিলেন। তখন দাদি বলেন উনার সব কষ্টের কথা এবং তিনি জানান আমাদের কাছে থাকার ইচ্ছা। তখন আমি আর বাবা পরিকল্পনা করে আমার সব চাচাকে একসাথে বসিয়ে বুঝাই যে, দাদি চাইছেন আমাদের কাছে থাকতে। উনার ইচ্ছার তো একটা গুরুত্ব আছে। অবশেষে সবাই বুঝিতে পারেন এবং তারা মেনে নেন। আমি আর আমার বাবা তাদের কথা দেই যতই সমস্যা হউক না কেন সবাই দাদির প্রতি অধিকার স্থাপন করতে পারেন এবং সবাই ইচ্ছা মত দাদির সাথে দেখা করতে পারেন। সবাই তা মেনে নেন। আমি পড়া লেখায় ভাল ছিলাম। ক্লাস ফাইভে আমি প্রথম বিভাগে পাস করি। সবাই খুশি হবার অভিনয় করে তবে মন থেকে সবার মনে হিংসা যেন আরও বেশি বেড়ে গেল। তবে একজন মনথেকে অনেক খুশি হন, আর তিনি ছিলেন আমার দাদি আর আমার অহংকার হয় আমার দাদি আমার সাথে আছেন। আমার এক চাচা আমাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা নামকরা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করান। দাদির আপত্তি সত্ত্বেও আমাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। স্কুলটা সত্যিই অনেক সুন্দর। তবে স্কুলে পড়া লেখার চেয়ে মারামারিই বেশি হয়। আর এই মারামারির সুযোগ নেয় রাজনৈতিক দলগুলো। যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তার উপর সে মারামারির সব দায় ফেলা হতো আর বলা হতো সরকারের দেশ শাসন ব্যবস্থা ভাল না। আর সরকার পক্ষ থেকে বিরোধী দল সমর্থনকারীদের উপর পুলিশদ্বারা প্রহার করা হতো।


বছরের বেশিরভাগ দিনই স্কুল বন্ধ থাকতো। একবছরে মনে হয় ৩০টি ক্লাসও হতো না। এদিকে আমাদের পরিবারে সমস্যা বাড়তে থাকে। এখন কেউ কারর সাথে কথা বলতো না। আর কেউ কারর ঘরে আসতো না। কেউ দাদির সাথেই সম্পর্ক রাখতো না। কোনো কোনো সময় কোনো চাচা দাদির সাথে দেখা করে যান। দুই বছর পর আমি বুঝতে পারি যে, এই স্কুল থেকে আমি কোনো কিছুই শিখতে পারবো না। তাই আমি আমার গ্রামের একটা ছোট স্কুলে চলে আসি। অষ্টম শ্রেনিতে ভর্তি হই। আমি ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের কাছে একটা খারাপ দৃষ্টিতে পরে যাই। ছোট বড় অধিকাংশ লোকের কাছ থেকেও আমি আমার উপযুক্ত সম্মান পাই না। এই স্কুলে এসে আমি অনেক ভাল একটা বন্ধু পাই। যে সব সময় আমার সাথেই থাকে। আমি সাধারনত বাড়ির বাইরে বের হতাম না। তবে এখন প্রতিদিন বিকালে আমি আর রাজ ঘুরতাম। আমার বাড়ি আর তার বাড়ির মধ্যে প্রায় ৩ থেকে চার কিলোমিটার রাস্তা ছিল। আমরা মাঝামাঝি একটা জায়গায় প্রতিদিন দেখা করতাম। এইভাবেই চলতো আমার দিনগুলো। আমার এলাকার কারর সাথে আমি মিশতাম না। পরের বছর অর্পা স্কুলে ভর্তি হবে, তাই আমি ঘরে ওকে পড়াতাম। ধীরে ধীরে আমার মনে হলো আমি হয়তো সুখের ছায়া পাচ্ছি। এমনিতে তো আমার কোনো চাচাতো ভাইদের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না, আমি তাদের সাথে ঠিক মত কথাই বলতাম না। 

No comments:

Post a Comment

Post Bottom Ad