ভাল এবং খারাপ সময় সবারই থাকে। খারাপ সময় যতটা কষ্ট দেয় তার চেয়েও অধিক সুখ লাভ হয় ভাল সময়ে। আর যদি সেই ভাল সফলতার মাধ্যমে শুরু হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। আর বেশির ভাগ মানুষের জীবনে ভাল সময় বিশেষ করে সফলতার মাধ্যমে আগমন ঘটে।
ঠিক এমনই একটি দিন এলো আমার জীবনে। দশ বছরের হতাসা আর দুই বছরের চেয়ে অধিক সময়ের পরিশ্রম আজ সফলতার মুখে। আজ আমার মাধ্যমিক পরিক্ষার ফলাফল বের হবে। চিন্তায় আমি পরিক্ষার পরের তিন মাস চুলও কাটিনি। আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছি এবং ফজরের নামাজ পড়েছি। আব্বুও প্রবাসে অনেক চিন্তায় আছেন। এখন পরযন্ত প্রায় ৭ বার আমার কাছে ফোন দিয়ে চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন। দুপুর ২টায় ফলাফল অনলাইনে দিবে আর স্কুলে এর আধা ঘন্টা আগে ফলাফল পৌছে যাবে। তবে ভয়ে কেউ স্কুলে যাবে না এবং কোনো সারকে ফোনও দিবে না। এখন দুপুর ১২টা বাজে, আমি মোবাইল নিয়ে আমার এক বন্ধুর সাথে বের হলাম। তার বাড়ি আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। আমাদের এলাকায় এবার শুধু আমাদের দুজনের মাধমিক পরিক্ষার ফলাফল বের হবে। আমরা দুইজন একসাথে এক স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হই। আমাদের এমনই মিল ছিল যে আমার ক্লাস নাইনে রোল নং ছিল ৪০ এবং তার ৪১। রাজ ছিল তার নাম।
প্রায় সাড়ে ১২টায় দুইজন একত্র হয়ে একটা মসজিদে গেলাম, যেখানে খুব ভাল মোবাই নেট পাওয়া যায়। আমরা একসাথে যোহরের নামাজ পড়লাম। যোহরের নামাজ শেষ হতে হতে প্রায় ১.৪৫ হয়ে যায়। আমরা দুইজন মসজিদের বারান্দায় মোবাইল দিয়ে রেজাল্টের পেইজে প্রবেশ করলাম। ঠিক দুইটা এক মিনিটে রাজের ফলাফল পেয়ে যায়। ৪টা বিষয়ে লেটার নিয়ে সে মাধ্যমিক পাস করে। তবে আমার ফলাফল আসতে একটু দেরি হচ্ছিলো। পনের মিনিটের মাথায় আমার ফলাফলও বের হয়। ৭টা বিষয়ে লেটার নিয়ে আমিও মাধমিক পাস করি। ফলাফলয়াটা ছিল অবিশ্বাস্য। তাই যাচাই করার জন্য আমরা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এরই মধ্যে রাজের প্রেমিকা তাকে ফোন দিয়ে জানালো যে, সেও মাধ্যমিক পাস করেছে। সেও আমাদের সাথে পড়তো মানবিক শাখায়।
পরে আমরা স্কুলে যাই এবং ফলাফল যাচাই করে আমরা সাইকেলে করে নিজের বাড়ি। বাড়িতে সবাই অনেক খুশি হন, বিশেষ করে আমার আম্মু আর আমার দাদি। এদিকে পরেরদিন আমার চাচাতো বোনের বিয়ে। তাই আমি আর বিলম্ব না করে চুল কেটে রাতে আপুর গায়ে হলুদে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিলাম। সন্ধ্যার পর রাজও চলে আসলো। আমরা দুজনই অনেক আনন্দের সাথে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করলাম। পরেরদিন বিয়ে হয়, দুই অনুষ্ঠানেই রাজ উপস্থিত হয় এবং আমরা অনেক আনন্দ করি। আমার ফোন দিয়ে রাজের মাধ্যমে দুই হাজারেরও অধিক ছবি উঠাই। ছবি তুলতে তুলতে রাজের হাতে ব্যাথা হয়ে যায়।
কয়েকদিন পরে কলেজে আবেদন করার সময় আসে। আমারা কলেজে আবেদন করি। তারপর আসে রমজান মাস। আমি পুরো রমজান মাসে তারাবির নামাজের পরে নিজের মনের আকুতি থেকে সৃষত ভাবনা থেকে সেহরির আগ পরযন্ত উপন্যাস লিখতাম এবং দিনে আসরের নামাজের পরে সেই উপন্যাস কম্পিউটারে টাইপ করতাম। এক মাসের অধিক সময় পরে আমি আমার উপন্যাস সম্পুর্ন লিখি এবং কম্পিউটারে টাইপ করে PDF ফাইল প্রস্তুত করে নিজের কাছে রেখে দেই এবং পরিচিত কয়েকজন বন্ধুকে তা দেই।
ঈদ অনেক আনন্দে কাটলো। ঈদের কয়েক দিন পরে কলেজে ভর্তির রেজাল্ট বের হয়। আমার সদরে একটা সরকারী কলেজে ভর্তির অনুমোদন হয় এবং রাজের নাটরে একটা সরকারী কলেজে। বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি বলে আমার কষ্ট হচ্ছে না বরং ভালই লাগছে। অনেকেই বলেছে বাড়ি ছেড়ে গেলে বুঝতে পারবো বাড়ির জন্য টান। তবে আমার তা মনে হয় না। কষ্ট তো এখানেই হয় যে রাজ আর আমি দূরে চলে যাচ্ছি। আর রাজের জন্যও খারাপ লাগছে যে, সে আর তার প্রেমিকার দেখা সহজে পাবে না। তার প্রেমিকা তাদের এলাকার একটা কলেজে ভর্তি হয়। তো কী আর করার, নিজেরা নিজেদের নির্ধারিত স্থানেই চলে গেলাম।
শিশির ভেজা শীতের সকাল, নতুন পরিবেশ, একা একাই বসবাস, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করে নিজের মর্জি মতো একা একা চলা। এমনটাই তো চেয়েছিলাম আমি, কোনো কিছুতে কারর কোনো বাধা নেই, কোনো মাথা গরম করা উপদেশ নেই, সামাজিক কোনো নিদৃষ্ট নিয়ম কানুন নেই। ভালই লাগছে। নিজের রান্না নিজে করা, সবকিছুই কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমাকে যে বাসা দেওয়া হয়েছে সেটাতে আমি একাই থাকি। অবশ্য আমার একা থাকতেই ভাল লাগে।
প্রথমদিন কলেজে গেলাম, কয়েকজনের সাথে পরিচয়ও হলো এবং বন্ধুত্বও। শুনেছি এই কলেজে রেগিং খুব বেশি হয়। আরও শুনেছি কলেজের বড় ছাত্ররাই নাকি কলেজ শাসন করে। কলেজ বন্ধ থেকে শুরু করে পরিক্ষার সময় পরযন্ত সবই তাদের কথায় চলে। এক কথায় বলতে গেলে তারাই কলেজ পরিচালনা করে আর পরিচালনা কোমিটি শুধু তা হা করে দেখে। তবে আমার মনে হয় না এমনটা হবে বলে। কলেজ শাসন করবেন শিক্ষকগন, ছাত্ররা না। কয়েক দিন ভালই কাটলো। কিছু দিন পর আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটে, যা আমাকে এই ব্যাপারে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।
আমি কলেজের গেইটের মধ্যে প্রবেশ করলাম। একসময় এক পাশ থেকে একটা ছেলে আমাকে ডাকলো,
- এই ছেলে, এদিকে এসো।
আমি গেলাম তার কাছে। সে বলল,
- তোমার ছাতাটা আমাকে দাও, আমি বাইরে যাবো।
শীতের এই সময় রোদের তাপ একটু বেশিই থাকে। তাই আমি ছাতাটা দিয়েই দিলাম। পরদিন ছাতাটা চাইলে আর ছাতাটা পেলাম না। ভাবলাম একটা ছাতাই তো। ঘটনাটা এখানেই শেষ হলে ভাল হতো। কিন্তু না, দিন দিন আরও অনেক ছাত্রকে তারা শাসাতে লাগলো। কাউকে বললে তারা আমাকে বলে, “আমি প্রথম দেখছি, এমনটা প্রায়ই হয়“। আমার সাথেও এমনটা কম হচ্ছিল না। একদিন তো একটা ছেলে আমার মানিব্যাগ জোর করে নিয়ে গেল। আরও তারা আমাকে আর আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে সিগারেট কিনিয়ে আনলো। আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে সারের নিকট যেতে চাইলাম। কিন্তু সে গেল না। আমি একাই গেলাম সারের নিকট। কিন্তু সারও ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। সারের কাছ থেকে ফিরে আসার পর সেই ছেলেগুলো নানা কথা বলতে শুরু করে।
No comments:
Post a Comment